অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম

সাবেক উপাচার্য ও অধ্যাপক (ভাইরোলজি), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

অন্য সকল শিশুর মতো মায়ের স্নেহ, বাবার শাসনে বেড়ে ওঠার সৌভাগ্য তাঁর ছিল না। খুব ছোটোবেলায় মাকে হারান তিনি। মৃত্যুশয্যায় মা একবার পাশ ফিরে দেখেছিলেন তাঁকে, এরপর সাদা কাফনে জড়ানো মায়ের নিথর দেহ নিয়ে যাওয়া হয় দাফনের জন্য। মায়ের স্মৃতি বলতে এটুকুই তাঁর সম্বল। পঞ্চম শ্রেণিতে থাকাকালীন তিনি বাবাকেও হারান।

বাবা-মাকে হারিয়ে ডা. মো. নজরুল ইসলাম বড় হয়েছেন চাচার কাছে। চাচা সরকারি চাকুরীজীবী হওয়ায় তাঁর কৈশোর কেটেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কখনো ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ, কখনো রাজশাহী; চলার পথে পেয়েছেন অসংখ্য বন্ধু। ছোটবেলায় পাড়ার মঞ্চে আলী বাবা ও চল্লিশ চোরে চোরের ভূমিকায় অভিনয় করা সেই মানুষটি, ১৯৫৯ সালে পৌঁছে গেলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে। মেডিকেলের প্রতিটি বিষয়েই তিনি মেধার পরিচয় রেখেছেন। ১৯৬৪ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এম.বি.বি.এস শেষ করেন। এক বছর মেডিসিনে ট্রেনিং গ্রহণের পর, তিনি কর্মজীবন শুরু করেন তৎকালীন পাকিস্তান ভ্যাক্সিন ল্যাবরেটরির রিসার্চ সেকশনে শ্রদ্ধেয় ডা. কাজী আবদুল মনসুরের অধীনে।

অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম এর অসাধারণ প্রতিভার প্রকাশ তখনও বাকি ছিল। তিনি ১৯৬৭ সালে ইন্সটিটিউট অব পোস্টগ্র‍্যাজুয়েট মেডিসিন থেকে মাইক্রোবায়োলজিতে অনার্স পেয়ে উত্তীর্ণ হয়ে ভাইরোলজির সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ভাইরোলজিতে পি.এইচ.ডি -র জন্য সেন্ট থমাস হসপিটাল এন্ড মেডিকেল স্কুল অব লন্ডন এ যাবার জন্য কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পান।

১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের স্কলারশিপ ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এই বীর বাঙালী, ছিনিয়ে আনেন বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। যুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলার নাগরিক পরিচয় নিয়ে তিনি লন্ডনে পাড়ি জমান; সেখানে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস নিয়ে গবেষণায় অসামান্য অবদান রাখেন। ১৯৭৭ সালে দেশে ফিরে মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টে ভাইরোলজির অধ্যাপক হিসেবে পুনরায় যোগদান করেন। একইসাথে চালিয়ে যান হেপাটাইটিস বি ভাইরাস নিয়ে তাঁর কাজ ও ব্লাড ট্রান্সফিউশনে স্ক্রিনিং এর জন্য উদ্যোগ। ১৯৮১ তে এইডস নামক মরণব্যাধির মহামারীতে তিনি তাঁর সর্বোচ্চ দিয়ে কাজ করে গেছেন। বাংলাদেশে AIDS প্রতিরোধে গঠিত ন্যাশনাল ফোরামে তিনি ছিলেন মেম্বার সেক্রেটারি। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় ২০০০ সালে ব্লাড ট্রান্সফিউশনের পূর্বে HIV, HBV, HCV, malaria, Syphilis স্ক্রিনিং বাধ্যতামূলক ও স্ক্রিনিং ছাড়া ব্লাড ট্রান্সফিউশন শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হয়।

তিনি বিশ্বাস করেন এবং সবসময় বলেন, “Speak out, let the people know.” পরিবর্তন আনতে, সচেতনতা সৃষ্টিতে এবং জানতে; প্রশ্ন করতে হবে, আওয়াজ তুলতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন সময়ও তিনি ছিলেন আপোষহীন, স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। মানবতার এই সেবক উপাচার্য পদ থেকে অব্যাহতি দিতেও দ্বিতীয়বার ভাবেন নি।